চল্লিশের দশক আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। ইংরেজরা দীর্ঘদিন ধরে ভারতবর্ষকে শাসন করে আসছিল অত্যন্ত নির্দয়ভাবে। মানুষ তাদের এই দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ক্রমে ফুঁসে উঠছে। ভারত জুড়ে শুরু হয়েছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন।
ব্রিটিশরাও নানাভাবে ফন্দি আঁটছে কীভাবে এই আন্দোলনকে দমিয়ে তাদের শাসনকালকে আরও দীর্ঘায়িত করা যায়। তারা তখন তাদের দেশীয় দোসর কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সাংঘাতিক এক দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি করে দেশে।
‘তেতাল্লিশের মন্বন্তর’ নামে পরিচিত সেই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ প্রবলভাবে নাড়া দেয় ‘আধুনিক চিত্রকলার জনক’ জয়নুল আবেদিনকে।
তখন পৃথিবী জুড়ে চলছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তার আঁচ এসে লাগে আমাদের বাংলা অঞ্চলেও। ব্রিটিশ শাসকেরা সেই সময় তাদের সৈন্যদের খাবারের জন্য সব চাল তুলে নিয়ে যায় বাজার থেকে। ফলে সারা দেশে, বিশেষ করে বাংলার গ্রামাঞ্চলে তখন নিদারুণ খাদ্যাভাব দেখা দেয়। মানুষ দুমুঠো অন্নের জন্য হাহাকার করতে থাকে। গ্রাম ছেড়ে হাজার হাজার মানুষ শহরে এসে ভিড় করে খাবারের সন্ধানে। তাদের প্রধান গন্তব্য হয় কলকাতা মহানগর।
কিন্তু সেখানেও ততোদিনে ছড়িয়ে পড়েছে খাদ্যের অনটন। গ্রাম থেকে আসা এইসব ছিন্নমূল মানুষ তখন অখাদ্য-কুখাদ্য খেতে শুরু করে। আবর্জনা থেকে কুড়িয়ে খাওয়া থেকে আরম্ভ করে কুকুরের মুখ থেকে খাবার কেড়ে নিয়ে তারা কোনোমতে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভাতের ফ্যান চেয়ে নিয়ে খিদে মেটায়। কিন্তু এক পর্যায়ে সেই ফ্যানটুকু পাওয়াও দায় হয়ে ওঠে। অনাহারে, অসুস্থতায় একসময় সেইসব হতভাগা মানুষেরা ধুঁকে ধুঁকে মারা যেতে থাকে, কলকাতার ফুটপাত ভরে ওঠে খাদ্যাভাবে মৃত মানুষের স্তূপাকার লাশে। ছেলে, বুড়ো, মেয়ে, শিশুর লাশের পঁচা গন্ধে কলকাতার বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। কাক শকুনেরা ঠুকরে খায় সেইসব পঁচাগলা মৃতদেহ।
জয়নুল তখন আর্ট কলেজের তরুণ শিক্ষক। চোখেমুখে অনেক স্বপ্ন। বুকে দেশপ্রেমের আগুন। তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না। মানবতার এত বড় অপমান, ইতিহাসের এই কলঙ্কজনক অধ্যায়কে তিনি লোকচক্ষুর সামনে, বিশ্বের নজরে আনার লক্ষ্যে আঁকতে শুরু করলেন সেইসব হৃদয়বিদারক দৃশ্যের ছবি। নাওয়া-খাওয়া ভুলে রং-তুলি আর কাগজ নিয়ে জয়নুল তখন কলকাতা চষে বেড়াতে লাগলেন ফুটপাতে পড়ে থাকা হাড়সর্বস্ব, রোগজর্জর, অনাহারী মানুষের ছবি আঁকার জন্য। তার নিজেরও তখন প্রচণ্ড অর্থাভাব। ছবি আঁকার সরঞ্জাম কেনার সঙ্গতি নেই। কিন্তু কোনোকিছুতেই তাকে দমিয়ে রাখা গেল না।
তার সেইসব ছবি কালক্রমে ‘মন্বন্তরের ছবি’ নামে বিশ্ববিখ্যাত হয়।